সকাল সাতটা বাজতেই এই বাড়ির একটি ঘর থেকে কোকিলের ডাক শোনা যায়। যে ঘরে কোকিল ডেকে উঠে, সে ঘরটি মিষ্টির। ঘরটি খুব ছিমছাম পরিপাটি করে সাজানো, কোথাও কোন বাহুল্য নেই। ঠাকুরদাদার আমলের মেহগনি কাঠের খাট, খাটের দু’পাশে দুখানা তেপায়া টেবিল, খাটের উল্টোদিকে বেলজিয়াম কাঁচের আয়না বসানো ড্রেসার, একপাশে সিংহাসন চেহারার আরাম কেদারা, এটিও ঠাকুরদাদার আমলের, আরেকটি কাঠের আলমারী। কোকিলটা ডেকে উঠে বিছানার বাম পাশে সাইড টেবিলে রাখা ঘড়ির ভেতর থেকে, ঘড়িটি মিষ্টির পঞ্চম জন্মদিনে ওর মামা উপহার দিয়েছিল, মামাবাবু নিজে হাতে সকাল সাতটার অ্যালার্ম সেট করে দিয়েছিলেন, মামাবাবু আজ বেঁচে নেই কিন্তু সেই থেকে প্রতি দিন সকাল সাতটায় কোকিলটা ডেকে উঠে।
আজও কোকিলের কুহু কুহু ডাক শুনে মিষ্টি বিছানা ছেড়েছে, বিছানার ডান পাশে, শিয়রের দিক বরাবর ছোট একখানি সিংহাসন, সেখানে মিষ্টির মায়ের ছবি। প্রতি সকালে হাত-মুখ ধুয়ে, জামাকাপড় পালটে মিষ্টি মায়ের ছবির সামনে দশ মিনিটের জন্য চুপটি করে বসে, দেহ-মনকে মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসার চেষ্টা করে, এভাবেই একসময় ওর মন হালকা হয়ে যায়, মনের সকল গ্লানি কেটে যায়, দিন শুরু হয় সুন্দর তাজা ঝরঝরে মন নিয়ে।
আজও মিষ্টির মন ফুরফুরে আছে, শুধু ফুরফুরে নয়, সাথে অন্যরকম এক অনুভূতি যোগ হয়েছে। অনুভূতিটুকু কেমন তা বলে বুঝানো যাবে না, কিছুটা ভালো লাগা এবং ব্যথা ,অপমান মেলানো এ অনুভূতি।
আজ অমিত আসবে, দীর্ঘ ছয় বছর পর দু’জনে দেখা হবে। গত পরশু সকালে অমিত দুবাই এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করেছিল, “ মিষ্টি, আমি খুব জরুরী কাজে সাত দিনের জন্য দেশে আসছি, প্রথমেই চিটাগাং যাচ্ছি, সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী পরশু সকালে তোমার সাথে দেখা হবে।”
মিষ্টি তো প্রথমে বুঝতেই পারে নি, অমিত কী বলছে, দেশে আসার কথা কেন বলছে, মিষ্টির সাথে দেখা করবে, চিটাগাং আসবে, কেন? মিষ্টির সাথে ওর কী প্রয়োজন? ডিভোর্সের কথা পাকাপাকি করতে চায়? তা এর জন্য দেশে আসতে হবে কেন, নিউইয়র্ক থেকে ডিভোর্স লেটার মেইল করে দিলেই হতো। কিন্তু ফোনে তো আর এসব বলা যায় না, মিষ্টি খুব নিরুত্তাপ গলায় বলেছিল, “ দেশে আসছো? খুব ভালো তো, তা চিটাগাং কখন এসে পৌঁছাবে? আমি এয়ারপোর্টে গাড়ি পাঠাবো”
অমিত বলেছে, “ না না, তোমাকে গাড়ি পাঠাতে হবে না, এত উতলা হওয়ার কিছু নেই। আমি হোটেলে রুম বুকিং দিয়ে রেখেছি, সরাসরি হোটেলে উঠবো, এরপর যাব তোমাদের বাড়ি। দেখা হবে, ভালো থেকো। শ্বশুরমশাইকে আমার প্রণাম জানিও”।
মিষ্টি ওর বাবাকে জানিয়েছে অমিতের কথা, বাবাও অবাক হয়ে বলেছে, “ অমিত আসছে? কোন অমিত?”
বাবার প্রশ্ন শুনে মিষ্টি হেসে দিয়েছে, “ বাবা, অমিত, তোমার জামাই বাবাজী, ভুলে গেলে?”
মিষ্টির বাবা একটু অপ্রস্তুত হলেন, “ ওহ হো! অমিত, তা ভাল করে বুঝিয়ে বলবি তো। আমার বয়স হয়েছে, অনেক কথা ভুলে যাই, মানুষের নাম ভুলে যাই, চেহারা ভুলে যাই, তা এত বছর পর জামাই আসছে, খুবই আনন্দের কথা। জামাই আদরের ব্যবস্থা করতে হবে তো। তোর মা বেঁচে থাকলে কত ভালো হতো, জামাই আদর নিয়ে ভাবতে হতো না আমাকে”।
-বাবা, জামাই আদর নিয়ে তোমাকে উতলা হতে হবে না, অমিত খুব অল্প সময়ের জন্য আসছে, আমাদের বাড়িতে থাকবে না বোধ হয়, হোটেলে উঠবে।
-কেন, হোটেলে উঠবে কেন? তোর মা নেই, কিন্তু আমি তো আছি, শ্বশুরবাড়ি আসবে অথচ হোটেলে উঠবে, এ কেমন কথা? লোকে শুনলে বলবে কি”?
-বাবা, লোকে শুনলে কী বলবে তা নিয়ে ভাববার সময় নেই আমার। লোকের কথা লোকে বলুক, পরশু সকালে আসবে আমাদের বাড়ি, আগে দেখা হোক, আমরা নিশ্চয়ই তাকে যথাযথ আপ্যায়ন করবো।
-তাই তো, দাঁড়া দেখছি পাঁচুকে খবর দেই, ডাঙ্গাবাজার থেকে একখানা খাসী কিনে আনুক, জামাইকে জামবাটি ভর্তি করে মাংস খেতে দেবো।
-বাবা, আস্ত খাসী কেন?
-বাহ! এত বছর পর জামাই আসছে, বাড়ি ভর্তি মানুষ, একটা খাসী তো লাগবেই।
-বাড়ি ভর্তি মানুষ মানে?
- বা রে, তোর ‘পাহাড়চূড়া’র বুড়োবুড়িদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবি না?
-হা হা হা! এই কাজটা তুমিই করো বাবা। জামাইয়ের গলায় গোলাপের মালা পরিয়ে বুড়োদের কাছে নিয়ে যেয়ো, বলো, দেখুন এই যে আপনাদের ‘ঠানদিদি’র বর, আমেরিকা থেকে এসেছে বেড়াতে।
ছয় বছর হয়ে গেলো অমিতের উপর অভিমান করে মিষ্টি আমেরিকা থেকে চলে এসেছে, বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ও, খুবই লক্ষ্মী একটা মেয়ে। এই লক্ষ্মী মেয়েটা কেন হুট করে সব ছেড়েছুড়ে দেশে চলে এলো, তা নিয়ে দত্ত বাবু অনেক ভেবেছেন, স্ত্রীর সাথে এই নিয়ে কত দিন আলোচনা করেছেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। নিউইয়র্কে থাকতো অমিত আর মিষ্টি, দুজনেই খুব ভালো চাকরী করতো, বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি, বিশাল বাড়িতে স্বামী আর স্ত্রী, ভালোই তো কেটে যাচ্ছিলো দিন, হঠাৎ করেই মিষ্টি জানালো ওর নাকি আমেরিকাতে আর ভালো লাগে না। দেশে চলে আসবে, মা-বাবার সাথে থাকবে। ওর স্বপ্ন ছিল একটি বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তোলার, বুড়ো বুড়িদের প্রতি মিষ্টির বরাবরই দূর্বলতা ছিল, ও সব সময় বলতো, সুযোগ পেলে অসহায় বুড়ো মানুষদের জন্য ও আধুনিক মানের বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলবে, যেখানে বুড়ো বুড়িরা জীবনের বাকী দিনগুলো মনের আনন্দে, সম্মানের সাথে কাটাবে। দত্তবাবু ভাবতেন মেয়ে তার কথার কথা বলছে, তরুণ্যে কত সুন্দর সুন্দর স্বপ্নই তো দেখা যায়, পরিণত বয়সে ক’জন সেই স্বপ্নের কথা মনে রাখে! কিন্তু মিষ্টি মনে রেখেছে, ও বৃদ্ধাশ্রম বানাবেই এমন পণ করেই কাজ শুরু করেছিল। দত্তবাবুদের এই পৈতৃক বাড়ীটি বিশাল জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ৬০ বছরেরও বেশী সময় ধরে। এই বাড়ির ওয়ারিশান মিষ্টির উপর বর্তাবে, তাই দত্তবাবু বাড়ির মালিকানা মিষ্টির নামে দানপত্র করে দিয়েছিলেন যেন মিষ্টি ওর স্বপ্নের বৃদ্ধাশ্রম বানাতে নিজের বাড়ীটি ব্যবহার করতে পারে।
বাড়িটি অনেকদিন ফাঁকা ছিল, বিয়ের পর অমিতের সাথে মিষ্টি চলে গেলো আমেরিকা, দত্তবাবু আর তাঁর স্ত্রী মন্দিরা দেবী, পুরনো আমলের দুই চারজন কাজের লোক, এই তো ছিল এই বাড়ির সম্পদ।
ছয় বছর আগে মিষ্টি এলো, এক বছরের মধ্যেই বাড়িটিকে বৃদ্ধাশ্রম বানিয়ে ফেললো। বাড়ির নামই পালটে গেছে, এই বাড়ির নাম এখন ‘পাহাড়চূড়ো’, এখানে সব মিলিয়ে ২১ জন বুড়োবুড়ি আছেন, খুব আনন্দে কেটে যাচ্ছে সকলের জীবন। আশেপাশের সবাই এখন পাহাড়চূড়ো কে চেনে, রিকসাওয়ালা, টেম্পোওয়ালা বলে, বুড়াবুড়িগো হোটেল। মিষ্টির স্বপ্ন সফল হওয়ার পথে, সবই ঠিক আছিল, তবু দত্তবাবুর বুকের কোথাও চিনচিনে ব্যথা ছিল, মেয়েটার হাসিখুশী মুখের আড়ালেও বিষাদের ছায়া উনি ঠিকই দেখতে পান। নিজে পছন্দ করে বিয়ে করলো, কত সুখে ছিল ওরা, তবুও কেন মিষ্টি চলে এলো?
প্রায় দশ বছর পর বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ালো অমিত, এটি অমিতের শ্বশুরবাড়ি। যদিও ছয় বছর মিষ্টির সাথে দেখা নেই, তবুও কাগজে কলমে এখনও মিষ্টি অমিতের বিবাহিতা স্ত্রী, বুকভরা অভিমান নিয়ে অমিতকে কিছুই না বলে ছয় বছর আগে মিষ্টি আমেরিকা থেকে চলে এসেছিল। গত ছয় বছর মিষ্টির সাথে দেখা না হলেও ফোনে টুকটাক কথা হয়েছে, হাই! কেমন আছো, কেমন চলছে তোমার পাহাড়চূড়া, শরীর ভালো তো? জাতীয় কথাবার্তা, স্বামী-স্ত্রীর প্রেমালাপ নয়।
বাড়ির চেহারায় কিছু পরিবর্তন হয়েছে, রাস্তার ধার ঘেঁষে পাঁচিলটি আগে ছিল না, কোলাপসিবল গেটটিও নতুন সংযোজন, রাস্তা থেকে বাড়ির ভেতর দেখা যায় না। কোলাপসিবল গেটের দুই পাশ থেকে জুঁইয়ের লতা গেট জড়িয়ে খুব সুন্দর করে গেটের লোহার খাঁচাকে ঢেকে ফেলেছে। এখন অবশ্য লতায় কোন ফুল দেখা যাচ্ছে না। যখন সাদা জুঁই ফোটে, কত সুন্দর লাগে কে জানে! নিশ্চয়ই মিষ্টি লাগিয়েছে জুঁইয়ের লতা, নিউইয়র্কের বাড়িতে মিষ্টির হাতে লাগানো জুঁইয়ের লতায় এখনও ঝেঁপে ফুল ফুটে।
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভালো দেখায় না, অমিত কলিং বেলে হাত ছুঁতে গেলো, তার আগেই ভেতর থেকে কেউ একজন গেট খুলে দিলো। যে গেট খুলে দিল, তাকে দেখে অমিতের দম আটকে আসার যোগার। মিষ্টির বাবা স্বয়ং দাঁড়িয়ে, অমিত কল্পনা করেনি মিষ্টির বাবা এসে গেট খুলবেন। এটাই এই পরিবারের রীতি, গৃহকর্তা নিজে অভ্যর্থনা জানিয়ে অতিথিকে ঘরে ডেকে নেন। অবাক মুহূর্তটুকু সামলে নিয়ে অমিত নীচু হয়ে দত্তবাবুর পা ছুঁইয়ে প্রণাম করলো, দত্তবাবু অমিতের মাথায় হাত ছুঁইয়ে আশীর্বাদ করলেন। অমিত জিজ্ঞেস করলো, “ কেমন আছেন বাবা?”
দত্তবাবু অমিতের পিঠে হাত রেখে সামনের দিকে যেতে যেতে বললেন, “ ভালো আছি, এই বয়সে যতটুকু ভালো থাকা যায়, তার চেয়ে অনেক বেশী ভালো আছি। মিষ্টির মা নেই, এই অপূর্ণতাটুকুও মিষ্টি ঢেকে দিচ্ছে।
সারাদিন অমিতের বেশ ভালো কাটলো, মিষ্টিকে দেখে মনেই হলো না ছয় বছর পর দেখা হয়েছে। সেই আগের মত আছে মিষ্টি, তরতাজা, সতেজ চেহারা, মুখের চেহারায় কোথাও বয়সের এতটুকু ছাপা নেই, চোখ দু’টো এখনও তেমনই চঞ্চল, তেমনই কথা বলে, চোখ জুড়ে শুধুই ভালোবাসা। এই নারী ছিল শুধুই অমিতের, আজ এই নারী আর কারো নয়, শুধুই নিজের। কী ভীষণ আত্মবিশ্বাসী দেখা যাচ্ছে মিষ্টিকে, একটা পরিবর্তন এসেছে মিষ্টির স্বভাবে, ও খুব শান্ত হয়ে গেছে, আগের মত চঞ্চলতা, ছটফটে ভাব নেই। এই নারীটি ছিল শুধুই অমিতের, আজ সব অতীত হয়ে গেছে।
বিকেলবেলা মিষ্টি বলল, চলো, কাল সকালের বাস ধরে কক্সবাজার চলে যাই। অনেককাল যাইনি, মা চলে যাওয়ার পর বুড়ো বুড়ীদের নিয়ে সময় কেটে যায়, ইদানিং মনে হচ্ছিলো, একটু ব্রেক দরকার। তুমি না এলেও আমি হয়তোবা কোন বন্ধুকে নিয়ে কক্সবাজার বেড়িয়ে আসতাম।
-তাই! আহারে, আমি তো তাহলে উড়ে এসে জুড়ে বসে গেলাম!
-হা হা হা! হলোই বা, উড়ে এলেও অচেনা গাছের ডালে তো বসোনি, চেনা গাছ।
-মিষ্টি, চলো কাল সকালে না বেরিয়ে আজই বেরোই, এখনই রওনা দেই। বাসে চড়ে না, হুড খোলা গাড়ি চড়ে যাব।
-নাহ! এখন যাওয়া যাবে না, আজ রাতেও না, দুই দিনের জন্য যাব, ফারিয়াকে সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া, গাড়ি নিয়ে যাব না, বাসেই যাব। গাড়িটা রেখে যাব ফারিয়ার জিম্মায়, যদি হঠাৎ কোন জরুরী প্রয়োজন হয় তাহলে ও ব্যবহার করতে পারবে।
-তোমার গাড়ি নিতে হবে না, আমিই গাড়ি নেবো।
-নাহ! তা হয় না, তুমি আমার অতিথি, তুমি কেন গাড়ি ভাড়া করবে? ভয় পেয়ো না, মুড়ির টিনে যাব না, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ভলভো বাসে চড়ে যাব।
-ওহ! ভুলে গেছিলাম, সত্যিইতো আমি তোমার অতিথি। ঠিক আছে, বাসে করেই যাব, মুড়ির টিন কথাটা অনেক বছর বাদে শুনলাম। আচ্ছা, মুড়ির টিন বাস কি এখনও চলে?
-চলবে না কেন? এদেশে মুড়ির টিন বাসে চড়ার মানুষই তো বেশী, তোমার-আমার মত ভদ্রলোক, বড়লোকরা তো নিজেদের গাড়িতেই চলাফেরা করে, নাহলে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ভলভোতে।
-আমি বড়লোক নই, আগেও ছিলাম না, এখনও নই। বড়লোক নই বলে আমার কোন অভিযোগও নেই।
-সরি অমিত, আমি ওভাবে বলতে চাইনি। বাদ দাও, চা খাবে?
-চা খাওয়ার অভ্যেস চলে গেছে, ছয় বছর হয়ে গেলো, চা পান ছেড়েছি।
অমিতের এই কথায় মিষ্টি অকারণেই চমকে উঠলো যেন, অমিতের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু পড়তে চেষ্টা করলো, না, সেখানে কোথাও ভালোবাসার কথা লেখা নেই, ছলনার চিহ্নও নেই! তাহলে ছয় বছরের কথা বললো কেন? মিষ্টিকে মনে করিয়ে দেয়া যে ছয় বছর আগে মিষ্টি অমিতের সংসার ছেড়ে চলে এসেছে? মনে করিয়ে দেয়ার কী আছে, ভুলে যাওয়ার জন্য ছয় বছর কী খুব বেশী সময়? ছয় বছর কেন, ছত্রিশ বছর পরেও কি মিষ্টি ভুলতে পারবে সেদিনগুলোর কথা?
প্রসঙ্গ পালটে মিষ্টি বলল, তাহলে ঐ কথাই রইলো, কাল সকালে আমরা কক্সবাজার যাব।
অমিত হেসে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, আপাততঃ এক কাপ চা খেতে চাই।
মিষ্টি হেসে ফেললো, ওর মনে পড়ে গেলো, অমিত আগেও চা খেতে চাইতো না, কিন্তু মিষ্টি চা খেতে ভালোবাসে অথচ শুধু নিজের জন্য চা বানাবেনা, তাই অমিত বাধ্য হয়েই চা খেতে চাইতো যাতে ওর কারণে মিষ্টির চা খাওয়া হয়। এই মানুষটি একসময় মিষ্টিকে কত ভালোবাসতো, মুখে তেমন কিছু বলতো না, কিন্তু মিষ্টি্র কত খুঁটিনাটি আবদার রক্ষা করতো। সেই মানুষটি আজ আর ওর নেই।
রাত আটটার দিকে অমিত উঠতে চাইলো, মিষ্টি বলল, “হোটেলে না গেলেই নয়?
অমিত মনে হয় মিষ্টির মুখ থেকে এই আহবানটুকুই শুনতে চেয়েছিল, সাথে সাথে সোফায় গা এলিয়ে দিল।
দুই)
সমুদ্র সৈকতে আজ খুব বেশী ভীড় নেই, গতকাল এই সময়ে বেশ ভীড় ছিল। অনেক বছর আমেরিকা কাটানোর কারণেই কিনা কে জানে, এত ভীড় অমিতের সহ্য হয় না। গতকাল সৈকতে পৌঁছে ঘন্টাখানেক পরেই অমিত হোটেলে ফিরে যেতে চেয়েছিল। গতকাল বেলা এগারোটার দিকে ওরা কক্সবাজার পৌঁছায়, মিষ্টির ইচ্ছেনুযায়ী ওরা হোটেল সৈকতে উঠে। বিয়ের একমাস পর ওরা হানিমুনে এসেছিল, তখন এই হোটেলেই উঠেছিল। রুম নাম্বারটাও মনে আছে মিষ্টির, ২১৫ নাম্বার স্যুইট ছিল, গতকাল রিসেপশানে লগ বুকে নিজের এন্ট্রির ঘর পূরণ করার সময় রিসেপসনিস্টকে মিষ্টি জিজ্ঞেস করেছিল,
-২১৫ নাম্বার স্যুইট কি পাওয়া যাবে?
রিসেপসনিস্ট তরুণ খুব মিষ্টি হেসে বলেছিল, সরি ম্যাম, ওটা ফাঁকা নেই, কিন্তু আমি আপনাদের জন্য আরও ভালো রুম দিচ্ছি, একেবারে সৈকতের দিকে মুখ, ব্যালকনিতে বসেও সমুদ্র দেখতে পাবেন।
-মিষ্টি একটু হতাশ সুরে বলল, মাই লাক! ঠিক আছে আপনার পছন্দমত রুমটাই দিন।
মিষ্টির মুখে ফুটে উঠা হতাশা অমিতের নজর এড়ালো না, ও রিসেপসনিস্টকে বলল,
-আরেকবার লগ বুকটা একটু চেক করবেন প্লীজ! বাই এনি চান্স, ২১৫ নাম্বার রুম যদি ফাঁকা থাকে!
-সরি স্যার, গতকাল ওটা বুকড হয়েছে, আমিই তা করেছি।
মিষ্টি বলল, না না, ঠিক আছে।
অমিত জিজ্ঞেস করলো, ২১৫ নাম্বার রুম চাইছিলে কেন?
-ও কিছু না, এমনিই। অনেক বছর আগে কক্সবাজার এসেছিলাম, ২১৫ নাম্বার রুমে উঠেছিলাম, নাম্বারটা মাথায় রয়ে গেছে।
অমিতের মনেও পড়লোনা, অনেক বছর আগে অমিতের সাথেই মিষ্টি এসেছিল, ২১৫ নাম্বার রুমেই উঠেছিল, অমিতের সাথেই এই রুমে তিনটি দিন সুখের সমুদ্রে ডুবেছিল। অমিত সিগ্রেট পান করতো না, কিন্তু এক প্যাকেট বেনসন হ্যাজেস কিনেছিল, নতুন বউকে একটি বেনসন হ্যাজেসের শলা দিয়েছিল, মিষ্টি ভয় পাচ্ছিল সিগ্রেটে টান দিতে, পরম ভালোবাসায় অমিত শিখিয়ে দিয়েছিল কী করে সিগ্রেটে টান দিতে হয়, কী করে ধোঁয়া গিলে ফেলে নাক দিয়ে বের করতে হয়। নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করতে গিয়ে মিষ্টির সে কী কাশি, একেবারে বিষম খেয়ে চোখ উলটে যাওয়ার অবস্থা, কিন্তু এর মধ্যেই খিল খিল হাসি। সেবারই তো মিষ্টিকে নিয়ে অমিত হোটেলের বার-এ গেলো, সৈকতের ধারেই ছনের চালা দেয়া সুন্দর বসার জায়গা, অমিত দুই ক্যান বিয়ার নিয়েছিল দুজনের জন্য, খুব যত্ন করে ঢেলে দিয়েছিল একখানা সুদৃশ্য কাঁচের মাগে, কী সুন্দর সোনালী রঙ, সকল সংস্কার ভুলে মিষ্টি বিয়ারের মাগে চুমুক দিয়েছিল। চুমুক দিয়েই চোখ উলটে আসার অবস্থা, ঢক করে গিলে ফেলে বলেছিল, “ ইস! অনেক তেতো, মদ এতো তেতো খেতে?”
অমিত হেসে ফেলেছিল, বলেছিল, “ যাহ! মদ বলো না, মদ শুনতে ভালো লাগেনা, এটা বিয়ার, বার্লি থেকে বানানো। বিয়ার একটু তিতকুটে লাগে, এভাবে ঢক করে খেতে হয় না, চুক চুক করে খাও, সাথে কাবাব, ফিশ চপ, বাদাম খাও, ভালো লাগবে।
মিষ্টি আর খায়নি, অমিতও জোর করেনি। ওরা দুজনে সেবার হিমছড়ি গেলো, বার্মিজ মার্কেটে গেলো, ২১৫ নাম্বার রুমে যতক্ষণ ছিল, সে কী মজা, এত আনন্দ মিষ্টি এর আগে পায় নি তো! আজও মিষ্টির সব কথা মনে পড়ে, অমিতের কিছুই মনে নেই।
এবার পরিস্থিতি উলটো, অমিত এসেছে মিষ্টির সাথে, অমিত ভেবেছিল মিষ্টি বোধ হয় আলাদা দুটো রুম নেবে, কিন্তু মিষ্টি তা করেনি, ডাবল বেডেড এক রুমই নিয়েছে। অমিত অবশ্য এতটা আশা করেনি, রুমে ঢুকেই মিষ্টি এক বেডের দিকে ইশারা করে অমিতকে বুঝিয়ে দেয়, এক রুমে থাকলেও দুজনের বিছানা আলাদা।
আজ বিকেল হওয়ার একটু আগেই মিষ্টি সুন্দর করে সাজলো, মেরুন-কালো-হলুদ-সবুজ জংলী ছাপের সিল্কের শাড়ি, মেরুন রঙের কনুই অব্দি লম্বা হাতা ব্লাউজ, সাথে অক্সিডাইজড গহনা, চোখে গাঢ় কাজল, ঠোঁটে মেরুন রঙের ম্যাট লিপস্টিক, দুই ভ্রুর মাঝে মেরুন রঙের ছোট্ট টিপ, স্টেপ কাট চুলগুলো খোলা রেখেই ঘাড়ের পাশে, কানের পেছনে, ব্লাউজের ফাঁক গলে বুকের মাঝ বরাবর এলিজাবেথ আরডেন স্প্রে করলো। অমিত অবশ্য অত সাজ করলো না, জিন্সের প্যান্ট আর সাদা টি শার্ট, এই পড়েই দু’জন চলে এলো সৈকতে।
কাল সকালে ওরা চিটাগাং ফিরে যাবে। মিষ্টির মনটা অনেক দূরে চলে গেছে, গলার কাছে কিছু একটা আটকে আছে, ভালোইতো ছিলো বৃদ্ধাশ্রম ‘পাহাড়চূড়ো’ নিয়ে, ছয় বছর পর অমিত কেন এলো? কেন ওর বুকে ঝড় তুলতে চাইছে অমিত? অমিত কী জানতো না মিষ্টি ওকে কী প্রচন্ড ভালোবাসতো? বিয়ের পরেই অমিত যখন মিষ্টিকে বলল যে সে একসময় তার ভাগ্নীর প্রেমে পাগল ছিল, সমাজের কথা ভেবে প্রেমটা সফল হতে দেয়নি, এটা শুনে মিষ্টি কষ্ট পেলেও তো অমিতকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিল। তবুও অমিত মিষ্টির প্রতি কোন টান অনুভব করেনি, শেষ পর্যন্ত রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট শালিনির সাথে অ্যাফেয়ার তৈরী করে ফেললো! মিষ্টির কী বুক ভেঙ্গে যায়নি অমিতকে ছেড়ে, সংসার ছেড়ে, নিজের এত দারুণ ক্যারিয়ার ছেড়ে দেশে চলে আসতে? দেশে চলে এসেছে সেও তো ছয় বছর হয়ে গেছে, কই ছয় বছরে একবারও তো অমিত মিষ্টিকে ফিরে যেতে বলে নি! মিষ্টির মা মারা গেলো, আমেরিকা থেকে কত বন্ধুবান্ধব ফোন করেছে, অমিতও করেছিল, কিন্তু অমিত তো একটিবারের জন্য মিষ্টিকে বলেনি, “ আমি আসছি”। আজ কেন অমিত এলো!
বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়ছে, চুলগুলো উড়ছে, মিষ্টিকে দেখাচ্ছে মাস্তুল ছাড়া জাহাজের মত, অসহায় দিকভ্রান্ত! অমিতের বুকে মোচড় দিলো। ওরা দুজনেই রঙিন ছাতার নীচে বসেছিল, জোয়ারের সময় হয়ে এসেছে, নোনা জলে পা ভেজাবে বলে মিষ্টি চেয়ার থেকে উঠে জলের কিনারে দাঁড়িয়েছে। অমিত মিষ্টিকেই দেখছিল, চিটাগাং-এ আসার পর ওর মনে একটু দ্বিধা ছিল, মিষ্টি ওকে কীভাবে গ্রহণ করবে! কিন্তু অমিত মনে মনে ভীষণ অবাক হয়েছে মিষ্টির ব্যবহার দেখে। ওরা যখন একসাথে ছিল, তখনও মিষ্টিকে এতটা উচ্ছ্বল দেখেনি যতটা দেখছে গত দুইদিন ধরে। সেই উচ্ছ্বলতা কী ওর নিজেকে আড়াল করা নাকি গত ছয় বছরে নিজেকে নতুন রূপে প্রতিষ্ঠিত করা? উচ্ছ্বলতা যদি ওর পরিবর্তিত রূপ হয়েই থাকে, এই মুহূর্তে কেন ওকে এমন নিঃস্ব দেখাচ্ছে?
অমিত চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালো, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো মিষ্টির কাছে। গত দুই দিনে একবারও মিষ্টিকে ছুঁইয়ে দেখেনি, ওদের এখনও ডিভোর্স হয়নি, কাগজে কলমে এমনকি মনে মনেও ওরা দুজন স্বামী-স্ত্রী। মিষ্টির কাঁধে হাত রাখলে এতটুকু অন্যায় হবে না। অমিত বাঁ হাতটি মিষ্টির কাঁধে রাখতেই মিষ্টি কেঁপে উঠলো। কন্ঠস্বর খুব স্বাভাবিক রেখে অমিত বলল,
“মিষ্টি, যেবছর আমরা হানিমুনে এসেছিলাম, ঠিক এইখানটায় দাঁড়িয়ে তুমি বলেছিলে, সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ মিথ্যে বলতে পারে না, আজ তুমি বলো আমাকে ছেড়ে তুমি কেমন আছো?
মিষ্টি কেমন এক ঘোর লাগা কন্ঠে বলল, “ শালিনি কেমন আছে?
-ভালো আছে মনে হয়, লুইজিয়ানা ইউনিভার্সিটিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসারের চাকরী পেয়েছে, তিন বছর ধরে ওখানেই আছে। কয়েক মাস আগেই ওর একটি মেয়ে হয়েছে।
-মিষ্টি আর্তনাদ করে উঠলো, মেয়ে হয়েছে মানে?
-মেয়ে হয়েছে মানে আবার কী? শালিনির বিয়ে হয়েছে তো সেই কবে, রিসার্চ নিয়ে ব্যস্ত ছিল তাই এতদিনে বাচ্চা হলো, ওরা খুব খুশী, বাচ্চার কত ছবি পাঠিয়েছে। শালিনির কথা থাক, তুমি কেমন আছো বললে না তো!
শালিনির মেয়ে হয়েছে শোনার সাথে সাথে মিষ্টির বুকটা ধ্বক করে উঠেছিল, মিষ্টির বুক জুড়ে এখনও অপমানের জ্বালা, রিসার্চের কাজে দারুণ ব্যস্ততা বলে অমিত প্রায়ই গভীর রাতে বাড়ি ফিরতো, একা বাড়িতে মিষ্টির ভুতের ভয় করতো, তবুও অমিতের কাজে যেন বিঘ্ন না ঘটে, এই ভাবনাতেই ও টিভি চালিয়ে মাঝ রাত অব্দি জেগে থাকতো। একদিন অমিতের ঘাড়ের কাছে কালচে লাল দাগ দেখে মিষ্টি খুবই শকড হয়েছিল, সেদিন থেকেই বিছানা আলাদা, দেশে ফিরে আধুনিক ধরণের বৃদ্ধাশ্রম খোলার পরিকল্পনা শুরু করেছিল। ওর বাবা ওকে পুরো বাড়ি বৃদ্ধাশ্রম করার জন্য দানপত্র করে দেন। মিষ্টি বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান, সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশান। অমিতকে কিছুই না জানিয়ে এক বুক অভিমান বুকে নিয়ে মিষ্টি ছয় বছর আগে বাবার কাছে চলে আসে। জামাইয়ের সংসার ছেড়ে আসা নিয়ে মিষ্টিকে ওর বাবা বা মা, দুজনের কেউই গাল-মন্দ করেননি, তবে ওকে বুঝাতে চেষ্টা করেছেন, সংসার গড়ে তোলা যতখানি কঠিন, সংসার ভেঙ্গে ফেলা তার চেয়েও বেশী কঠিন। মিষ্টি বাবা-মায়ের সাথে বিতর্কে যায়নি।
অমিত জানতে চেয়েছে, অমিতকে ছাড়া মিষ্টি কেমন আছে? মিষ্টি মনে মনে বলল, তোমাকে ছেড়ে থাকবো বলে কী ভালোবেসেছিলাম? তুমিই তো আমাকে চলে আসতে দিলে। কিন্তু মুখে বলল, দুই দিন ধরে তো দেখছো, আমার কত কাজ, সারাদিন ব্যস্ত থাকি বুড়ো বুড়িদের নিয়ে, বুঝতেই পারিনি আমি কেমন আছি? ছয় বছর পর তুমি এমন প্রশ্ন করাতে চমকে গেছি, আসলেই তো, আমি নিজেই জানিনা আমি কেমন আছি।
জোয়ার শুরু হয়েছে, সমুদ্রের জল রঙিন চেয়ারগুলোর পা ভিজিয়ে যাচ্ছে। মিষ্টির শাড়ি হাঁটু পর্যন্ত ভিজে গেছে, তা নিয়ে মিষ্টির কোন উৎকন্ঠা নেই, অমিতের কাছে মনে হলো, মিষ্টি অনেক বদলে গেছে। শাড়ির প্রতি মিষ্টির ভীষণ দূর্বলতা ছিল, এত দামী সিল্কের শাড়ি এভাবে সমুদ্রের নোনাজলে ভিজে যাচ্ছে, দশ বছর আগে হলেও এটা সম্ভব ছিলো না। শাড়ি কুঁচকে কুঁচকে হাঁটুর উপরে তুলে ফেলতো, নগ্ন পা সবাই দেখে ফেলছে তা নিয়ে ভ্রূক্ষেপও করতো না, পা নয়, শাড়ী বাঁচানোই প্রধান কাজ হতো।
দুজনে এসে চেয়ারে বসলো। বাদামওয়ালাকে ডাকলো মিষ্টি, অমিত চিনেবাদাম খুব ভালোবাসতো, এখনও নিশ্চয়ই বাসে। চিনেবাদামের ঠোঙা খুলে অমিত বাদাম নিয়ে ভাঙ্গতে শুরু করলো, মিষ্টি জিজ্ঞেস করলো,
“অমিত, সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ মিথ্যে বলতে পারেনা, ছয় বছর পর তুমি কেন এলে?”
-তোমাকে দেখতে, আমাকে ছাড়া তুমি কেমন আছো তা দেখতে এসেছি। তুমি অনেক বড় ভুল ধারণা নিয়ে চলে এসেছো, ছয় বছর পর দেখা, ঊর্মির কথা জানতে চাইলে না, শালিনির কথা জানতে চাইলে কেন?
-ঊর্মির কথা তোমার কাছে জানতে চাইবো কেন, ঊর্মির সাথে তো আমার হরদম কথা হয়। শালিনির কথা তুমি ছাড়া আর কেইবা জানবে? শালিনি ছিল তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, রিসার্চ পার্টনার। দুজন রিসার্চের কাজে এত বেশী মশগুল থাকতে যে বাড়িতে মিষ্টি নামের একটি মেয়ে তোমার প্রতীক্ষায় বসে থাকতো, পরদিন সকালেই মেয়েটিকে ল্যাবে যাওয়ার জন্য ছুটতে হতো, এসব কিছুই খেয়াল করতে না।
-মিষ্টি, একটু আগেই তো বলেছি, তোমার ধারণা ভুল ছিল, শালিনি বিবাহিতা ছিল।
-শালিনি যে বিবাহিতা, তা একটু আগে জানলাম। আমি যা দেখেছি, তাতে শালিনি বিবাহিতা হলেই কি, অবিবাহিতা হলেই বা কি, প্রেম হচ্ছে প্রেম।
অমিত, শোন বলি, তোমার সাথে আমার পরিচয়ের শুরুটা এত বেশী সুন্দর ছিল যে বিয়ের পরের দিনই যখন তুমি বলেছিলে, বিয়ের আগে অর্পির সাথে তোমার গভীর প্রেম ছিল, মামা-ভাগ্নি সম্পর্কের কারণ প্রেম শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি, বিশ্বাস করো, অন্য যে কোন মেয়ে নতুন বরের মুখ থেকে এমন কথা শুনে সহ্য করতে পারতো না, কিন্তু আমি পেরেছিলাম। রাগ করার বদলে উলটো তোমার জন্য কষ্ট পেয়েছিলাম এই ভেবে যে আহারে, আমি নাহয় কালো বলে কেউ আমাকে ভালোবাসেনি, কিন্তু অমিত তো দারুণ স্মার্ট, সুদর্শন, এত ভদ্র, শিক্ষিত, তবুও তার ভাগ্য এত খারাপ? এত গভীর প্রেম ছিল যার সাথে, সেটা সফল হলো না?
-মিষ্টি, এত বছর পর এসব পুরনো কথা নিয়ে আলাপ করলে তোমার মন আরও খারাপ হবে। আমি সত্যি করে বলছি, তোমার মন খারাপ হলে আমি কষ্ট পাব।
-আমার মন খারাপ হলে তোমার কষ্ট হবে? সত্যি বলছো?
-যে কারো মন খারাপ দেখলেই আমার কষ্ট লাগে।
-আচ্ছা, তাহলে মন খারাপ করবো না, এসো প্রসঙ্গ বদলে ফেলি। এবার আমি প্রশ্ন করি, তুমি কেমন আছো?
-তুমি যেমন রেখে এসেছিলে, ঠিক তেমনই আছি। সেই বাড়িতেই আছি, উইকএন্ডে চিকেন রান্না করি বেশী করে, সারা সপ্তাহ খাই। ঘর-দোড় ঝাড়ু দেয়ার জন্য একজন হিসপ্যানিক মহিলাকে ঠিক করেছি, ওর কাছে ঘরের চাবি দেয়া আছে, মহিলা মাসে দুই দিন এসে ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে যায়।
-মহিলার কাছে চাবি দিয়ে রেখেছো? হাতে করে কিছু নিয়ে গেলেও তো তুমি জানবে না?
-কী আর আছে আমার, কী-ইবা নিবে।
-হুম, কিছু নেই কেন? তোমাকে যাতে ল্যাবে রাত কাটাতে নাহয়, তার জন্য তো পুরো বাড়ি ছেড়ে দিয়ে এসেছি, সাথে কিছুই নিয়ে আসিনি।
-মিষ্টি, মিথ্যে কথা বলবো না, শালিনির সাথে অবশ্যই আমার কিছু একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছিল, আমরা মাঝে মধ্যে আবেগে চুমুও খেয়েছি, ঐ পর্যন্তই। কিন্তু যে রাতে ল্যাব থেকে ফিরে ঘর ফাঁকা পেলাম, তোমার চিরকুট পেলাম, সেই রাত থেকে আমি বদলে গেলাম। মনে করো, প্যারাস্যুটে চড়ে হাওয়ায় ভাসছিলাম, হঠাৎ করেই ঝড় এলো, ঝড়ের তান্ডবে প্যারাস্যুটের দুই স্ট্রিং ছিঁড়ে গেলো, মাটির কাছাকাছি এসে আমি পড়ে গেলাম, প্রাণে বেঁচে গেলেও কোমরের হাড় ভেঙ্গে গেলো, আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারলাম না।
মিষ্টির বুকটা ভীষণ ফাঁকা লাগছে, কোন অনুভূতিই কাজ করছে না। পাহাড় ওর যেমন প্রিয়, সমুদ্রও প্রিয়। ও ধীর পায়ে সামনের দিকে এগোলো, জলের কাছাকাছি পৌঁছাতেই পেছন থেকে অমিত বলে উঠলো, “ আর বেশী এগিয়ো না মিষ্টি, ভাটার টান কখন শুরু হবে, তুমি তো সাঁতার জানো না”।
মিষ্টি সাঁতার জানে না, হানিমুনে এসে প্রথম যেদিন অমিতের সাথে সমুদ্রে নেমেছিল, সমুদ্রের জলে ঝাঁপাঝাঁপি করার পুরোটা সময় অমিত মিষ্টিকে ধরে রেখেছিল যেন ঢেউয়ের ধাক্কায় মিষ্টি ভেসে না যায়। সমুদ্রের ঢেউ উঁচু হয়ে আসতে দেখলেই অমিত কী সুন্দর করে মিষ্টিকে উঁচু করে তুলে ধরছিল, ফাঁকে ফাঁকেই টুক করে চুমু খাচ্ছিলো মিষ্টির গালে, কপালে। আহ! কেন এগুলো মনে পড়ছে আজ। কী দরকার ছিল শালিনির কথা জানতে চাওয়ার। মিষ্টি তো জানেই অমিত কখনও মিথ্যে বলে না। এই তো বলে দিল, শালিনির সাথে অন্তরঙ্গতা হয়েছিল, এত বেশী অন্তরঙ্গতা যে চুমু খেতেও আটকেনি।
আচ্ছা, এখন যদি অমিত মিষ্টিকে চুমু খেতে চায় অথবা সেই আগের মত মিষ্টির কাছে আবদার করে, একটা চুমু দেয়ার জন্য তাহলে কী হবে? শালিনিকে যে ঠোঁট দিয়ে চুমু খেয়েছে অমিত, সে ঠোঁটে মিষ্টি কি আর ফিরে কখনও নিজের ঠোঁট ছোঁয়াতে পারবে? কিন্তু এই মুহূর্তে, সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে মিষ্টির একটু মিছে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা, ওর খুব ইচ্ছে করছে এক দৌড়ে অমিতের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। কত কাল ঐ বুকে মিষ্টি মাথা রাখেনি, কারো চোখের দিকে তাকায়নি, কাউকে ভালোও বাসেনি। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে, মিষ্টির দেহে-মনে খরা চলছে, বৃষ্টি নামেনি। দেহে ও মনে সতেজ মেয়েটি আজ কতগুলো বুড়োবুড়ির মাঝে দিন কাটাচ্ছে।
অমিত ডাকছে, মিষ্টি চলো ঐ কটেজগুলোর দিকে যাই।
মিষ্টি ঘুরে দাঁড়ালো, অমিত মুগ্ধ দৃষ্টিতে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকলো। এ কোন বিষাদময়ী রূপসী, এই নারীটি তার ছিল, আজ কত দূরের হয়ে গেছে! কাগজে কলমে এখনও ওরা স্বামী স্ত্রী, অথচ গত আট বছর কেউ কাউকে স্পর্শ করেনি। এই রূপসীর দেহে উত্তাপ ছিল, সেই উত্তাপ কী আজও তেমনই রয়ে গেছে নাকি অপমানে শীতল হয়ে গেছে! এই রূপসী নারীর দু চোখে জল কেন, অমিতের কী উচিত জিভের আলতো ছোঁয়ায় চোখের জলটুকু শুষে নেয়া!
নাহ! তা সম্ভব হবে না, অমিতের সেই সুযোগ আর নেই, মিষ্টি ওকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, অমিতও ভালোবাসতো মিষ্টিকে কিন্তু মিষ্টির মত প্রকাশ করতে পারতো না। শালিনিকে তো অমিত ভালোবাসেনি, একসাথে কাজ করতে করতে বন্ধুত্ব, বন্ধুত্ব থেকে নির্ভরতা, শালিনির স্বামী ওকে খুব যন্ত্রণা দিত, মেয়েটা এত ব্রিলিয়ান্ট ছিল, রিসার্চের কাজে দারুণ আগ্রহ অথচ স্বামীর কাছ থেকে সহযোগীতা পেতো না। মিষ্টি আর অমিতের মধ্যে তখন কেমন যেন এক ধরণের শীতলতা চলছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে অমিত আর শালিনি কিছুটা কাছাকাছি চলে আসে, আমেরিকাতে একজন আরেকজনকে চুমু খেতেই পারে, কিন্তু ওদের চুমু যেন নিষিদ্ধতার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। যে রাতে ল্যাব থেকে ফিরে অমিত সারা বাড়ি ফাঁকা পেলো, মিষ্টি কোথাও নেই, তখনও সে আন্দাজ করতে পারেনি মিষ্টি বাংলাদেশে চলে গেছে। কিছুদিন আগেই তো মিষ্টি ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া গেছিলো ঊর্মির কাছে, তেমনই কোথাও গেলেও তো বলে যাওয়ার কথা ছিল। মিষ্টির ফোন নাম্বারে ডায়াল করে ফোন বন্ধ পেয়েছে। এরপর তো বেড সাইড টেবলে চিরকুট পেলো,
“ অমিত, আমি বাংলাদেশে চলে গেলাম, আর আসবো না। তোমাকে ডিভোর্স দিতেই পারতাম, কিন্তু দেবো না। জীবনে শুধু তোমাকেই পেয়েছিলাম, তাই সব ভালোবাসা তোমাকেই উজার করে দিয়েছিলাম, তুমি বোকা ছিলে, আমার মত কালো মেয়ের প্রেমে পড়েছিলে, বিয়ে করেছিলে, এতেই আমি কৃতজ্ঞ ছিলাম। নিজেকে কখনওই মূল্যায়ন করিনি, তাই মূল্য বুঝিওনি। তুমিই ছিলে আমার কাছে সব, বিয়ের আগে তোমার প্রেম ছিল, সেটা শোনার পর কষ্ট পেয়েছিলাম তবে মেনেও নিয়েছিলাম, এতকাল পর শালিনির সাথে তোমাকে মানতে কষ্ট হচ্ছে, তোমাকে ডিভোর্স দেয়ার পর আমার বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করবে না। থাক, ডিভোর্সের দরকার নেই, তুমি থাকো শালিনিকে নিয়ে, আমি থাকবো বুড়ো বাবা-মা’কে নিয়ে”।
চিরকুট পড়ে মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছিলনা, রাত অনেক হয়ে গেছিল তাই ঊর্মিকে কল দিতে ইচ্ছে করেনি। সারারাত আর ঘুমায়নি অমিত, সকাল না হতেই ঊর্মিকে ফোন করেছে। ঊর্মির কাছেই মিষ্টির যাবতীয় পরিকল্পনার কথা জানতে পেরেছে। গত ছয় বছরে মিষ্টির সাথে ফোনে কথা হয়েছে, তবে সবই ছাড়া ছাড়া ধরণের। শালিনিকে মিষ্টির চলে যাওয়ার কথা বলতেই শালিনি স্তম্ভিত হয়ে গেছে, নিজেকে দায়ী করে খুব কেঁদেছে, ধীরে ধীরে ওরা নীরবতাকে বরণ করে নিয়েছে। এরপর শালিনি নতুন চাকরী নিয়ে চলে গেছে লুইসিয়ানাতে, ওখানে ওরা ভালো আছে, ভালো নেই শুধু অমিত।
দুজনে এসে পৌঁছালো যে কটেজটির সামনে, এটি সেই হানিমুন সময়ের কটেজের মত নয়, এই কটেজে আধুনিকতার ছাপ বেশী। অমিত একটি চেয়ার মিষ্টির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বসো।
এরপর নিজেও বসলো, জানতে চাইলো, সফট অর হার্ড?
অমিতকে অবাক করে দিয়ে মিষ্টি বলল, হার্ড নাও আমার জন্য। ভদকা নাও।
-তুমি ভদকা নিবে? তা ঠিক আছে, ভদকা নাও, কিন্তু তুমি ভদকা নিতে চাইছো, কী ব্যাপার?
-তোমার সম্মানে, হানিমুনে এসে আমাকে বিয়ারের মাগে এক চুমুক দেওয়ানোর জন্য তোমার কত জোরাজুরি, তুমি নিয়েছিলে ভদকা, আমার দিকে গ্লাস বাড়িয়ে দিয়েছিলে, আমি নাক মুখ কুঁচকে সতীপনা দেখিয়েছিলাম। হা হা হা! কী লাভ হলো সতীপনা দেখিয়ে? আমি যে তিমির সে তিমিরেই রয়ে গেলাম।
-এখন ভদকা পান করলে তিমির দূর হবে?
-তা হবে না, কিন্তু তোমার সাথে শুরুর দিনে যা করতে পারিনি, জীবনের শেষের দিনে তা করতে চাই।
-শেষের দিন বলছো কেন? আমি কি আজ সমুদ্রের ঢেউয়ে ভেসে যাব?
-বালাই ষাট! ভেসে যাবে কেন? আজ আমাদের শেষ সন্ধ্যা এখানে, কাল চলে যাব চিটাগাং, আর তো সুযোগ হবে না।
-মিষ্টি, পাহাড়চূড়া দেখে আমি মুগ্ধ, তুমি ১০০% সাকসেসফুল। এখন তো পাহাড়চূড়াতে ২১ জন বৃদ্ধ আছেন, এই পাহাড়চূড়া একদিন বাঙ্গালী সমাজে আইকন হয়ে থাকবে। ভালোই তো উপভোগ করলাম বুড়ো-বুড়িদের পরস্পরের প্রতি আদর ভালোবাসা, আড্ডা সব মিলিয়ে দারুণ প্রাণের ছোঁয়া।
-তোমার ভালো লেগেছে পাহাড়চূড়া?
-দারুণ! যাক, একটা কথা জিজ্ঞেস করি, সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে কেউ মিথ্যে বলেনা, তাইতো?
-হ্যাঁ, তাই।
-মিষ্টি, তুমি আমাকে কী আগের মত ভালোবাসো?
-ঠিক বলতে পারছি না
-আচ্ছা থাক, আগের কথা বাদ দেই, আমাকে নতুন করে ভালোবাসবে?
-সমুদ্রের সামনে অতীত আর বর্তমান বলা যায়, ভবিষ্যত কি বলা যায়?
-তুমি মিষ্টি, দারুণ লক্ষ্মী এক মেয়ে, তুমি ভবিষ্যতের কথা বলো প্লীজ, ভালোবাসবে?
-আমি তোমাকে আগের মতই ভালোবাসি অমিত
-আমি আজ তোমাকে ছোট্ট একটা অনুরোধ করবো
-ক’রো প্লীজ!
ভদকার গ্লাসে মিষ্টি কী কায়দা করে চুমুক দিচ্ছে দেখো, একেবারে পাকা হয়ে গেছে। অথচ এই মেয়েই একদিন বিয়ারের মাগে চুমুক দিয়ে থু থু করে ফেলে দিয়েছিল।
কোটের পকেট থেকে একটি মুখ বন্ধ খাম বের করলো অমিত, খামটির কোথাও এতটুকু কোঁচকায়নি, মিষ্টির দিকে এগিয়ে ধরতেই মিষ্টি চমকে গেলো, বলল, তুমি ডিভোর্স লেটার নিয়ে এসেছো অমিত?
-জানিনা ডিভোর্স কিনা, আমি চাকরীতে ইস্তফা দিয়ে দিয়েছি, বাড়িটা বিক্রী করে দিয়েছি, ব্যাংকে যা কিছু জমেছিল, তার থেকে কিছু নিজের জন্য রেখে বাকী সব এই খামে ভরে নিয়ে এসেছি।
মিষ্টি, পাহাড়চূড়া নিয়ে তোমার বিরাট স্বপ্ন ছিল, স্বপ্নের সিঁড়ি গাঁথা হচ্ছে, চূড়োয় পৌঁছে যাবে তুমি, তবে একার চেষ্টায় বেশী সময় লাগবে। আমি চাই, আমার সেই কৃষ্ণকলি খুব দ্রুত পাহাড়ের চূড়োয় পৌঁছাক, এই টাকাটা তোমাকে চূড়োয় উঠতে সাহায্য করবে। আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি, তোমাকে দেখার জন্য বুক ফেটে যাচ্ছিলো, তিনদিনে তোমাকে প্রাণ ভরে দেখলাম।
-কোথায় যাচ্ছো?
-আলাস্কা
-বরফের রাজ্যে যাবে তুমি? কেন?
-জানিনা কেন। কোথাও তো যেতে হবে, নিউইয়র্ক আমার অসহ্য লাগছে।
অমিতের হাতে খামটা তখনও ধরা আছে, মিষ্টি মাথা নীচু করে টেবিলে নখ দিয়ে আঁক কষছে। অমিত খুব নরম করে ডাকলো, মিষ্টি! মিষ্টি, আমি কি খুব বেশী নষ্ট হয়ে গেছি? ধরো, আমি নষ্টই হয়ে গেছি, কিন্তু আমার হাতে ধরা খামটা তো নষ্ট নয়, সৎ উপায়ে উপার্জিত অর্থ, একটি সৎ কাজে ব্যয় করতে চাইছি। আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবে?
মিষ্টি মুখ তুলে তাকালো, দুই চোখ ছাপিয়ে জল পড়ছে! মিষ্টির এমনিতেও কান্নার বাতিক আগেই ছিল, এখন যেন বাধা মানছে না। চোখ না মুছেই ভাঙ্গা গলায় বলল, “ অমিত, তুমি আলাস্কা চলে যাবে? এত দূর? আর কোনদিন তোমার ছোঁয়া পাবো না। নিউইয়র্ক ছিলে, মনে হতো হাতের নাগালেই আছো, কল্পনাতেই তোমাকে ছুঁয়েছি, আলাস্কা নামই জানি, আলাস্কা নিয়ে তো কেউ ভাবিনা, হয়তো বেশী দূরে নয়, কিন্তু নিউইয়র্কের মত আপন নয়। তুমি একা একা অতদূরে থাকবে কীভাবে?
-আমাকে ছেড়ে চলে এলে ছয় বছর হয়ে গেলো, কখনও ভেবেছো তোমাকে ছাড়া আমি একা আছি কিভাবে? আমি কিন্তু প্রতিদিন ভাবতাম, আমাকে ছাড়া মিষ্টি একা একা কী করে দিন কাটায়? ও কি রাতের বেলা ভুতের ভয় পায় না?
-ভুতের ভয়ের কথা বলতেই মিষ্টি ফিক করে হেসে দিলো, বলল, আমি প্রতি রাতে লাইট জ্বালিয়ে রেখে ঘুমাই, ভুতের ভয় একটুও কমেনি। অমিত, আলাস্কা যেয়ো না, নিউইয়র্কেই থাকো। প্রতি বছর এক মাসের জন্য পাহাড়চূড়ায় বেড়াতে আসবে, বুড়ো বুড়ীদের সাথে কাটিয়ে যাবে কিছুটা সময়।
-থাকবো কোথায়?
-পাহাড়চূড়াতেই থাকবে, তোমাকে থাকতে দেবো খালেক চাচার সাথে, ৮৬ বছর বয়স হয়েছে চাচার, সারাক্ষণ শুধু পকর পকর করতেই থাকে, সাতকূলে কেউ নেই, তুমি থাকবে চাচার সাথে।
-কেন, বুড়োর সাথে থাকবো কেন, বুড়োর ঠানদি’র সাথে থাকতে পারবো না?
অমিত এখন জানে, বুড়ো বুড়িরা সক্কলেই মিষ্টিকে আদর করে ‘ঠানদিদি’ বলে ডাকে। অমিতের কথা শেষ হতেই মিষ্টির মুখে লজ্জা মেশানো হাসি ফুটে উঠলো। ভদকার নেশায় ধরেছে দুজনকেই, মিষ্টি গেয়ে উঠলো,
“আমি ছিলেম তোমার প্রেমের প্রথম স্বপ্ন নায়িকা
লিখেছি তোমার মনের আখরে অনেক ছন্দ লিপিকা
সেদিন যেন আজও মনে পড়ে যায়
কেমন করে যেন আমায় খুঁজে পায়---
আর গাইতে পারলো না, মিষ্টিকে আজ কান্নায় পেয়েছে, অমিতের বুকে সমুদ্রের গর্জন, খুব আলতো করে মিষ্টির হাত দুটো ধরলো, মিষ্টি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না, অমিতের হাত দুটো ধরে কাঁদতে লাগলো। অমিত দিশেহারা হয়ে গেলো, চারদিকে শুনশান নীরবতা, অমিতের খুব ইচ্ছে করছে, মিষ্টিকে বুকে টেনে নিতে। এই মেয়েটা ওকে প্রাণ উজার করে ভালোবেসেছিল, আজও সে ভালোবাসায় এতটুকু খাদ নেই, এই মেয়েকে ছেড়ে ছয় বছর কী করে কাটিয়েছে অমিত?
অমিত নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠলো, দুই হাঁটু গেড়ে মিষ্টির সামনে বসলো, খুব রোমান্টিক ছবিতে যেমনি দেখায়, নায়ক নায়িকাকে প্রপোজ করছে, Will you marry me?, অমিত অবশ্য অতটা করলো না, খুব নরম করে বলল,
“মিষ্টি সোনা, আমরা নিজেদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, আর সইতে পারছি না, আমার যত অপরাধ, এই সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে বিসর্জন দিলাম, এই মুহূর্তে আমি একজন বিশুদ্ধ প্রেমিক হতে চাই, আমি তোমাকে চাই, আবার সেই আগের মত করে পেতে চাই। তুমি কী আমার হাত দুটো ধরবে?